২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর
Md. Ashraful Haque, 17-Nov-2012
ভিউ : 89242
সুত্র: প্রথম-আলো
২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসবে মরুর দেশ কাতারে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে নির্মাণকাজ। স্থাপনা নির্মাণের এই মহোৎসবের পুরোভাগে আছেন কীর্তিমান বাংলাদেশি প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন
শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ছন্দের কৌশলে গান রচনা করতেন ছাত্রজীবনে। এখন অতি আধুনিক নগর রচনার কাজে ব্যস্ত। মধ্যপ্রাচ্যের ধনাঢ্য দেশ কাতারে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। তার জন্য চলছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ। তারই অন্যতম রূপকার বাংলাদেশি প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন।
কাতারের ইংরেজি দৈনিক দ্য গালফ টাইমস এবং দেশটির পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের প্রেস বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরের জন্য কাতারের অবকাঠামো উন্নয়নের বাজেট ২০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে রয়েছে ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে একটি সুবিশাল বিমানবন্দর, ১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ দোহা মেট্রো লাইন ছাড়াও বিভিন্ন শহরে তৈরি হচ্ছে বেশ কয়েকটি স্টেডিয়াম। চার ও পাঁচতারকা মিলিয়ে তৈরি হবে অতিরিক্ত ৮০টি হোটেল। এই নতুন চেহারার কাতারের সড়ক উন্নয়ন, ড্রেনেজব্যবস্থা, সুয়ারেজ, পরিশোধিত পানি সরবরাহসহ যাবতীয় অবকাঠামোর সবকিছু সঠিক কি না তা অনুমোদন করার কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছেন বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান ৩০ জন প্রকৌশলী। তাঁদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশি প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মামুন বর্তমানে কাতার সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অবকাঠামো-বিষয়ক পরামর্শক।
নিজের বর্তমান কাজ সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাতার ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজকের দায়িত্ব পাওয়ার পর সেখানে ব্যাপক উন্নয়নের কাজ চলছে। এ জন্য প্রায় সব ধরনের অবকাঠামো, আবাসন প্রকল্প ও মেট্রোরেল নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। আমি কাতারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন অবকাঠামো পরিকল্পনা বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছি।’ নগরের বিশদ পরিকল্পনা তৈরিতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান ও অনুমোদনের কাজ করেন তিনি। যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব কী ধরনের হতে পারে, সে বিষয়ে তাঁর বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া হয়।
মামুন বলেন, বিশ্বকাপের জন্য কাতারে পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত হচ্ছে ১৩টি অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে খেলার মাঠে তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড রাখা হবে বলে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফাকে কথা দিয়েছে কাতার। সৌরশক্তি ব্যবহার করে কার্বন দূষণমুক্ত অভিনব যন্ত্রের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তিনি জানান, ১২টি স্টেডিয়ামের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম লুসইলেল আইকনিক স্টেডিয়াম। এখানে ৮৬ হাজার ৩০০ দর্শক একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারবে। অন্য স্টেডিয়ামগুলো হলো খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, স্পোর্টস সিটি স্টেডিয়াম, এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আল খোর স্টেডিয়াম, আল সামাল স্টেডিয়াম, আল ওকরাহ স্টেডিয়াম, উমম সালাল স্টেডিয়াম, দোহা পোর্ট স্টেডিয়াম, থানি বনি জাসামি স্টেডিয়াম, আহমেদ বনি আলী স্টেডিয়াম, কাতার ইউনিভার্সিটি স্টেডিয়াম।
মামুন কাতারে এসেছেন ২০০৮ সালে। তার আগে ১৯৮৮ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন। সেখানেও রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। সেখানকার নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেটের শোলহেভেন এলাকায় পরিশোধিত পানি ব্যবহারের একটি প্রকল্পের রূপকার ছিলেন। তিনি এমন একটি উপায় বের করেন যাতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়। প্রকল্পটির জন্য যে বাজেট বরাদ্দ হয়েছিল তার প্রায় অর্ধেক টাকা দিয়েই তিনি এই প্রকল্পের কাজ সারেন। সে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সালে পেয়েছেন দুটো মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার—নিউ সাউথ ওয়েলস প্রিমিয়ারস পাবলিক সেক্টর অ্যাওয়ার্ড ইন দ্য ইকনমি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সেক্টর এবং দ্য ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স অস্ট্রেলিয়ার ‘ইঞ্জিনিয়ার্স এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড’। সিডনি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পুরকৌশল বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকও ছিলেন তিনি।
সরকারি চাকরিজীবী বাবা নজির আহমদ এবং মা জয়নব বেগমের কনিষ্ঠ সন্তান আবদুল্লাহ আল মামুনের বাড়ি কক্সবাজার।
মামুনের জন্ম ১৯৫৯ সালের ৩১ জুলাই। চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে ১৯৭৫ সালে এসএসসি এবং ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান চুয়েট) ভর্তি হন। সেখান থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দেন। থাইল্যান্ডে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি শেষ করে ১৯৮৮ সালে অভিবাসী হয়ে যান অস্ট্রেলিয়ায়।
অস্ট্রেলিয়া থেকে কাতারে কীভাবে এলেন, জানতে চাইলে মামুন বলেন, ‘২০০৮ সালের প্রথম দিকে ইঞ্জিনিয়ার্সঅস্ট্রেলিয়া সাময়িকীতে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান মেগা প্রজেক্ট নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এ ধরনের অবকাঠামো-বিষয়ক মেগা প্রজেক্টে সম্পৃক্ত হওয়ার দুর্নিবার আকর্ষণই আমাকে মধ্যপ্রাচ্যের ধূসর প্রান্তরে নিয়ে যায়।’
লেখালেখি করছেন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে। আশির দশকে কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া মানুষের মুখে মুখে ফেরা সেই গান ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, সোলসের ‘এই মুখরিত জীবনের চলার পথে’ এবং তপন চৌধুরীর গাওয়া ‘ভুলে গেছ তুমি’র রচয়িতা মামুন। প্রকৌশলী হিসেবে শত ব্যস্ততার মধ্যেও মামুন তাঁর শিল্পীসত্তা ধরে রেখেছেন।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নগর উন্নয়ন, বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে বলে জানালেন তিনি।
কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, বিশ্বকাপ সামনে রেখে কাতারে যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে, সেসবের অন্যতম পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন মামুন। এখানকার উন্নয়নবিষয়ক সেমিনারে তিনি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন কদিন আগে। স্থানীয় পত্রিকা গালফ টাইমস-এ তাঁর প্রবন্ধের উদ্ধৃতিসহ সে খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে তাঁকে নিয়ে আমি গর্বিত।