ছাদের বাগান সুস্থভাবে শ্বাস নেবার প্রতিজ্ঞায়
Md. Ashraful Haque, 17-Nov-2012
ভিউ : 27780
"ছাদের বাগান সুস্থভাবে শ্বাস নেবার প্রতিজ্ঞায়............"
আমাদের ঢাকা শহরে যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৯ হাজার ৪ শত ৪৭ ( ১৯,৪৪৭ জন মানুষ বাস করে।
সেখানে ২০০০, ৩০০০ বা ৫০০০ বর্গ ফুট এর বাড়ির ছাদ গুলো তালা বন্ধ করে ফেলে রাখা সত্যি বিলাসিতা।
জার্মানি সহ গোটা ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ যেখানে জনসংখ্যা নেগেটিভ আয়তন অনেক বড় , সেখানে শুধু ছাদেই নয় জানালার কোনা থেকে শুরু করে বাড়ীর দেয়াল কোথাও বাকি নেই যেখানে তারা গাছ লাগায় না। স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরুকরে বুড়ো-বুড়ী সবার প্রকৃতি প্রেম। ৮০,৯০ বছরের বয়স্ক পুরুষ-মহিলাও সারাদিন বাগানে কাজ করে গাছের পরিচর্যা করে।এসব উন্নত দেশগুলোতে মালী বা কাজের লোকের বিলাসিতা নেই। বাজার রান্না ধোয়ামোছা বাগানের পরিচর্যা সার পানি দেয়া সব নিজেদের করতে হয়।
আর এইসব গাছের বেড়ে ওঠার জন্য যে সার দরকার তাও নিজেরাই ঘরে তেরি করে। অনেক গুলো বাড়ী থেকে কোন পচনশীল আর্বজনা পাওয়া যায় না মানে শূন্য পার্সেন্ট । বাংলাদেশে আগে গ্রামের বাড়িগুলোতে উঠোনে মাটিতে পুতে রাখার ব্যবস্থা থাকলেও শহরের বাড়িতে তা অসম্ভব।এখানে জার্মানিতে বাড়ির বাগানে নেটের একরকম খাঁচা থাকে যেখানে এরা প্রতিদিনের রান্না ঘরের পচনশীল বর্জ্যগুলো ফেলে রাখে সেগুলো পরে রোদে বৃষ্টিতে মাটিতে মিশে গিয়ে মাটি উর্বর করে।
আমাদের দেশেও বাড়ির ছাদে খোলা ড্রাম বা ইটের চারকোনা বাক্সে এক স্তর পচনশীল বর্জ্য এক স্তর মাটি বা বালি দিয়ে খুব সহজে জৈব সার বানানো যায় যেটা ওই বাড়ির ছাদের বাগানের সারের চাহিদা মেটাতে পারে।
বাড়ির প্রতিদিনের রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট থেকে একদিকে যেমন জৈব সার পাওয়া যায়, বাইরে থেকে সার কেনার দরকার হয়না অন্যদিকে বালি-ভর্তি অনুর্বর মাটির উর্বরা ফিরিয়ে দেয়া যায়।সব উন্নত দেশ এমনকি ভারতেও এখন বায়োফুড বা কেমিকেল সার ও কীটনাশক মুক্ত খাবার বা শাকসবজি চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
আমাদের পুরো ঢাকা শহর কঙ্ক ক্রিটে ঢাকা। কোথাও কোন খালি জায়গা নেই। যে কোন আবাসিক এলাকা যেমন বসুন্ধরার ১০০টি বাড়ীর ৫০০০ বর্গ ফুটের ছাদে ৫,০০,০০০ বর্গফুট খালি জায়গা। ছাদ গুলোর অর্ধেক খালি যায়গায় যদি শুধু কাঁচামরিচ লাগানো যায় ( বাংলাদেশে মসলাজাতীয় ফসলের মধ্যে মরিচের অবস্থান প্রথম সারিতে তারপরেও দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।কারণ মরিচ প্রতি বাড়িতে প্রতিদিন দরকার)।
একটি ৩০০০ বর্গ ফুটের ছাদে খালি ৩০ থেকে ৫০ টি গাছ অনায়াসে লাগানো যায়। কাঁচা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১০০-১২০ কেজি মরিচ পাওয়া যেতে পারে।
তাহলে পুরো ঢাকা শহরে বা দেশের বড় বড় শহর গুলোর ছাদে প্রচুর মরিচের সম্ভাবনা রয়েছে।
ফুলের টবে না লাগিয়ে পিলার বরাবর দেড় থেকে দুই ফুট গভীর ইটের চৌবাচ্চার মত হলে পানি বা সার দেয়া সহজ এবং জায়গা বেশি পাওয়া যায়।
চিলেকোঠার দেয়ালে একটি কবুতরের ঘর বানিয়ে দিলে রান্নাঘরের ভাত বা রুটির উচ্ছিষ্ট খেয়ে এক জোড়া কবুতর বাসায় নির্মল বিনোদন ও প্রশান্তি এনে দিতে পারে। সেই সাথে বাড়ির শিশুদের কিছু সময়ের জন্য ভিডিও গেম থেকে দুরে এনে ইট , কাঠ , পাথরের শহরেও প্রকৃতির প্রতি মায়া, মমতা ও ভালবাসার জন্ম দিতে পারে।কবুতরগুলোও আকাশে ডানা মেলে ইকো-সিস্টেম এর ভারসাম্য আনতে পারে।
একটি বাড়ির ছাদের চারদিকে দেয়ালের ধার এর পিলার বরাবর বাগান করা হলে পিলার সহজে মাটির বাড়তি ওজন এর ভার নিতে পারে।সিঁড়ি বা চিলেকোঠার একদিক বাদ রেখে বাকি তিন দিকে গাছ লাগানো যায়। এক পাশের দেয়ালের এই ইটের ঘর সব সময় খোলা রেখে এক স্তর বালি এক স্তর রান্নাঘরের পচনশীল বর্জ্য রোদে এবং বৃষ্টিতে ভিজে কম্পোস্ট হয়ে সার বানানোর জন্য রেখে বাকি দুই দিকে গাছ লাগানো যায়।বালি বা মাটি দেয়ার ফলে এই পচনশীল বর্জ্য গন্ধ ছড়াবে না। এর পরে সেটি পুরোপুরি ভরে গেলে গাছ লাগানোর তৈরি হয়ে গেল। ফলে বাইরে থেকে মাটি আনার দরকার নেই। রান্না ঘরের বর্জ্য পচে অনুর্বর বালির সাথে মিশে জৈবসার হয়ে গেল। এভাবে অন্য পাশের দেয়াল গুলো পর্যায়ক্রমে উর্বর মাটি তৈরি করে নিলে বাইরে থেকে সার বা মাটি আনার দরকার হয়না অন্যদিকে পচনশীল বর্জ্য কাজে লাগানো গেল।
আমাদের দেশের আবহাওয়া উচ্চ তাপমাত্রা ও প্রচুর আর্দ্রতা শীতপ্রধান দেশগুলোর তুলনায় অনেক দ্রুত জৈবসার তৈরি করে।
অন্যদিকে ঢাকার ৪,৫০০ টন বর্জ্য থেকে যদি ৫০০ টন জৈব সার পাওয়া যায়( প্রতি কেজি ইউরিয়ার সমপরিমাণ দাম হলে ১,৫০,০০,০০০ টাকার সার উৎপাদন সম্ভব। (ইউরিয়া আমদানিতে খরচ ৩০ টাকা প্রতি কেজি)এতে একদিকে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো গেলো অন্যদিকে অনুর্বর শুষ্ক মাটিতে উর্বরতা বাড়ানো যায়।
নজরুল ইসলাম খান পেশায় সচিব উনি তার মিন্টুরোডের সরকারী বাড়ির প্রতিটি কোন সবুজ গাছ লাগিয়েছেন পুরোটাই প্রাকৃতিক জৈব সার থেকে ইকো ব্যালেন্স করে।
ঢাকা শহরের অনেক এলাকা বিশেষ করে যেখানে বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে খুব সহজেই।ছাদের চিলেকোঠা থেকে সরাসরি
বাগানের গাছে পানি দেয়া, কাপড় বা গাড়ী ধোয়ার জন্য একটি আলাদা স্থায়ী বা ব্যবস্থা করার না হলে অস্থায়ী প্লাস্টিকের পানির ট্যাংক এ সংরক্ষণ করা গেলে পরে সরাসরি বা বিশুদ্ধ করে পরে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সবুজ চাষ করা মানে হল বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস আটকে আলাদীনের দৈত্যর মত বোতলে আটকে ফেলা ( কার্বন ট্র্যাকিং) সেই সাথে সুপ্ত তাপমাত্রা আটকে ফেলা। ঘরের ভেতরের মানি-প্লান্ট বা অন্য সবুজ গাছ যেগুলো রোদ ছাড়া বেঁচে থাকে তাও ঘরের ভেতরের বাতাস থেকে কার্বন বা বিষাক্ত গ্যাস শুষে নেয়। ঘরের ফ্রিজ, এসি, আইপিএস অন্য সব ব্যাটারী প্রতিনিয়ত বাতাসে দুষিত ক্যামিকেল নি:সরণ করে।
এ এক সত্যি বিস্ময় যেখানে আমরা শিশুদের খোলা আকাশ দেখাতে পারিনা জানালা খুলে তাকালে আর একটি জানালা। সেখানে ছাদ গুলো তালা বন্ধ রেখে স্বপ্ন গুলোকে সেই সাথে স্বাধীন ভাবে শ্বাস নেবার অধিকার টুকুও হত্যা করা হয়।ছাদে নিয়মিত সবজী বা ফুলের চাষাবাদের ফলে মুক্ত বাতাস আর প্রকৃতির স্পর্শ পাওয়া যেত অন্যথায় আমরা জোর করে শিশুদের পিষে ধরে অসুস্থ বড়দের টিভি সিরিয়াল, ভিডিও গেম বা ইন্টারনেটে আসক্ত করছি।
পৃথিবীর সব উন্নত দেশ গুলোতে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের ব্যাগ ও ভিন্ন ভিন্ন রঙের ড্রাম এর ব্যবহার করে আলাদাভাবে পচনশীল অ-পচনশীল বর্জ্য সংগ্রহ করার হলেও আমাদের দেশে এখনো কোন আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়না।
সুতরাং আজ থেকে শুরু হোক সবুজের আন্দোলন সেটা নিজের শোবার ঘর আর প্রতিটি বাড়ির বন্ধ ছাদ থেকে।নিজের আর নিজের সন্তানের সুস্থভাবে শ্বাস নেবার প্রতিজ্ঞায়। এর সঠিক বাস্তবায়নে সরকারের যথাযথ নীতিমালা প্রয়োজন ।সরকারী উদ্যোগ বাড়ানোর পাশাপাশি রয়েছে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যেমন প্রয়োজন তেমনি সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যমগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
রাশা বিনতে মহিউদ্দীন
স্টুডেন্ট অফ মাস্টার্স ইন ইনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এন্ড এগ্রিকালচারাল ফুড প্রডাকশন, ইন ইউনি হোয়েনহেইম, স্টুটগার্ট জার্মানি।
মন্তব্য সমুহ